Shafiq's Hajj

শুদ্ধতার সন্ধানে: শফিক সাহেবের হজ্জ অভিজ্ঞতা

“স্যার, ফাইলের কাজটা কি হয়েছে? বিলটা খুব দরকার” 

শফিক সাহেব শুধু আগুন্তক এর কথা শুনলেন আর মাথা নাড়লেন কোন উত্তর দিলেন না। আগন্তক ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করে চলে গেল।

শফিক সাহেব, একটি বড় সরকারি অফিসের একজন সম্মানিত কর্মকর্তা। তার পদের ভার, ক্ষমতা, সবই বেশ প্রশংসার যোগ্য। তবে তার কাজের পদ্ধতি ছিল একটু অন্যরকম। তার হাতে একবার কোনো ফাইল উঠলে, সেটি ছাড়তে গেলে ঘুষ দিতে হত। এটা যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। দিনের পর দিন অনেকেই এই নিয়ম মেনে ফাইল ছাড়িয়ে আনত।

কিন্তু যারা ঘুষ দিতে পারত না, তাদের ফাইল আটকে যেত শফিক সাহেবের ডেস্কে, জমে থাকতে থাকতে সেই কাজ আর এগোত না। তিনি বছর ধরে এভাবেই নিজের ক্ষমতা আর প্রভাব কাজে লাগিয়ে মানুষের থেকে ঘুষ নিয়ে যাচ্ছিলেন। সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা, ঘুষের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে সুবিধা দেওয়া—এসব ছিল তার প্রতিদিনের কাজ।

একদিন, এক বন্ধুর কাছে শুনলেন যে, তার অন্যান্য বন্ধুরা হজ্ব পালনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মনে হলো, এত বছর ধরে যা পাপ করেছি, আল্লাহর ঘরে গিয়ে সকল পাপ মোচন করতে হবে। সেই দিন থেকে তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল, যত দ্রুত সম্ভব হজ্জের জন্য টাকা সংগ্রহ করা। আগে যেখানে যেই ফাইল উনি ছাড়তে ১০ হাজার টাকা নিতেন তা হয়ে গেল ২০ হাজার। শফিক সাহেব ভাবছিলেন, এই টাকা দিয়েই হজ্জে গেলে সব পাপ ধুয়ে যাবে, তাই আর চিন্তা করার দরকার নেই।

তিনি ঘুষ নেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত হজ্জের খরচ জমাতে পারেন। এমনকি কিছু বড় প্রকল্পেও জালিয়াতি করে বেশ টাকা আত্মসাৎ করলেন। নিজের এই কাজে তিনি কোনো ভুল দেখলেন না, বরং এটাকে প্রয়োজনীয় মনে করলেন, কারণ তার ভাবনায় ছিল— হজ্জ করলে সব পাপ মাফ হয়ে যাবে।

হজ্জের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করে শফিক সাহেব যাত্রা শুরু করলেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি যখন তিনি কাবার সামনে দাড়ালেন তখন তার মনের মধ্যে সব সময় একটি ভার অনুভূত হতে লাগল। এতদিন ধরে যে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন, সেই বাস্তবতা যেন এক মুহূর্তে তার সামনে এসে ধাক্কা খেল।

তার সাথীরা সবাই হাউমাউ করে কাঁদছিল, কিন্তু শফিক সাহেবের চোখের কোনে এক ফোঁটাও পানি আসছিল না। তার ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল—”সবাই কাঁদছে, কিন্তু আমি কেন কাঁদতে পারছি না?

কা‘বা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন দোয়া করছিলেন, তখনও তার মনের কোণে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল: “আল্লাহ কি আমার এই হজ্ব গ্রহণ করবেন?”

শফিক সাহেব যে দলে ছিলেন, তাদের মুয়াল্লিম একজন দ্বীনদার আলেম, যিনি সর্বদা আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা করতেন। ইশার নামাজের পর মুয়াল্লিম সাহেব তাদের উদ্দেশ্যে বয়ান দিচ্ছিলেন। তিনি এক হাদিস শোনালেন: 

আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ থেকে একটি খেজুর সদকা করে, আর আল্লাহ্‌ তা কবুল করেন, কারণ আল্লাহ্‌ শুধু হালাল জিনিসই কবুল করেন। এরপর আল্লাহ্‌ তা নিজের ডান হাতে নিয়ে বড় করেন, যেমন তোমাদের কেউ ঘোড়ার বাচ্চাকে বড় করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যে তা পাহাড়ের সমান হয়ে যায়।”

(সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪১০)

শফিক সাহেবের বুকটা ধক করে উঠল। হঠাৎই তিনি উপলব্ধি করলেন, আল্লাহ ধন-সম্পদের উপর নির্ভরশীল নন, তিনি শুধু হালাল উপার্জনকেই কবুল করেন। তার হজের খরচের টাকা ছিল হারাম পথে অর্জিত—ঘুষ, দুর্নীতি। কিভাবে তিনি এই টাকা দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন? আর আল্লাহ হারাম উপার্জন কিংবা সম্পদ দ্বারা হজ্জ ও ‘উমরাহ করলে তা কবুল করেন না। এই টাকা দিয়ে হজ্জ করে কিভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন?

এক ধরনের গভীর অপরাধবোধে তার মন ভারী হয়ে গেল। সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারলেন না। বিছানায় শুয়ে না থেকে, উঠে জায়নামাজে বসে অনেক কেঁদে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এবার আর নিজের পাপকে ঢাকার চেষ্টা করলেন না। তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে, আর কখনো দুর্নীতির পথে হাঁটবেন না, আর কখনো হারাম টাকা দিয়ে ইবাদত করবেন না।

মুয়াল্লিম সাহেব তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, শফিক সাহেব জায়নামাজে বসে কাঁদছেন। তিনি শফিক সাহেবের পিঠে স্নেহভরে হাত রেখে বললেন, “আল্লাহ ক্ষমাশীল, যেকোনো গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন।”

শফিক সাহেব উপলব্ধি করলেন, বিশুদ্ধ আকীদা ও আমলের অধিকারী গাইড এবং সৎ, ভালো মানুষের সাথে হজ ও ‘উমরাহ না করলে হয়তো তার এই উপলব্ধি কখনোই আসত না। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, পরেরদিন সকালেই বাংলাদেশে তার ছোটবেলার বন্ধুর কাছ থেকে হালাল টাকা ধার নিয়ে হজের বাকি কাজ শেষ করবেন। সেইসাথে আগামীকাল থেকে মুয়াল্লিম সাহেবের কাছ থেকে হজ ও ‘উমরার বিশদ জ্ঞান অর্জন করবেন। কেননা, তিনি কোনো প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বা সঠিক জ্ঞান ছাড়াই হজ্জে এসেছিলেন, যা তাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল।

সেদিন আসরের নামাজের পর, মুয়াল্লিম সাহেব তাদের সবাইকে মসজিদুল হারামের বাইরে চত্বরে নিয়ে বসলেন। শায়খ তার প্রজ্ঞাময় বয়ান শুরু করলেন:

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাআলার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদেরকে হজ্জ করার তৌফিক দিয়েছেন। যেহেতু আমরা হজ্জের বেশ আগেই মক্কা শরীফে এসে পৌঁছেছি, আসুন আমরা প্রতিদিন আসরের নামাজের পর হজ্জের বিশুদ্ধ পদ্ধতি শিখতে চেষ্টা করি।

তিনি আরও বললেন, “আমরা যারা এখানে, মক্কা শরীফে হজ্জ পালনের নিয়তে এসেছি, তাদের জন্য প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্তই বিশেষ। আমরা আসরের নামাজের পর চেষ্টা করব, আমাদের হজ্জ যেন হয় শুদ্ধ, যেন একটিও ভুল না হয়। কারণ, হজ্জ শুধুই একটি ইবাদত নয়, এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ। আমরা এই পথে পা বাড়িয়েছি, আর আমাদের সকলকে সেই পথে সঠিকভাবে চলার কৌশল জানতে হবে।

তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, “আমাদের এই পবিত্র সফরে কিছু ভুল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই, আল্লাহ আমাদের সেই ভুলগুলো থেকে রক্ষা করবেন। আর ভুলগুলো শুরু হয় ইহরামের পূর্ব থেকেই।”

তারপর তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে বললেন, “আসুন, আমরা ইহরামের পূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু ভুল সম্পর্কে জেনে নেই। এ ভুলগুলো সাধারণ হলেও এর প্রভাব অনেক বড়।

শায়খ ধীরে ধীরে ভুলগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরতে লাগলেন, যেন প্রতিটি কথাই শফিক সাহেবের  আত্মাকে স্পর্শ করল।

“প্রথম ভুল,” তিনি বললেন, “হারাম উপার্জন বা সম্পদ দ্বারা হজ কিংবা উমরাহ পালন করা। আল্লাহর দরবারে কোন ইবাদতই শুদ্ধ হয় না, যদি তার ভিত্তি হারাম হয়।”

তারপর তিনি দ্বিতীয় ভুলের কথা বললেন, “সৎ ও বিশুদ্ধ আকিদার গাইড ছাড়া হজ্জ কিংবা উমরাহ পালন করা।” শায়খের কণ্ঠে ছিল আক্ষেপ, যেন আমরা সঠিক পথের দিশারী খুঁজে না পেলে পথ হারাবোই।

তৃতীয় ভুল হিসেবে তিনি বললেন, “হজ্জ ও উমরাহর সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ না নেওয়া।” শায়খের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ, যেন আমাদের সবাইকে তিনি জাগিয়ে দিতে চান এই বাস্তবতার সামনে।

এটা ইবাদত, লোক দেখানোর জন্য নয়, অনেকেই হজ্জে এসে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। তাওয়াফ করার সময় ফেসবুকে লাইভে চলে যায়। মনে হয় যেন তিনি হজ্জে এসেছেন তার ফলোয়ার দের সন্তুষ্টির জন্য,” তিনি সতর্ক করে বললেন, “এই রিয়া থেকে বাঁচতে হবে।”

নারীদের জন্য শায়খ বিশেষ করে স্মরণ করিয়ে দিলেন, “স্বামী বা মাহরাম ছাড়া হজ্জ করা যায় না। আর কেউ মিথ্যা মাহরাম সাজিয়ে হজ্জ করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

শায়খ গভীর উদ্বেগ নিয়ে তার বয়ান চালিয়ে গেলেন। তার কণ্ঠে শোনা যাচ্ছিল সতর্কবার্তার সুর, যেন প্রতিটি শব্দে তিনি সবাইকে ত্রুটিগুলো থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বললেন, “যদি আমরা কিছু ভুল করি, তাহলে আমাদের হজ্জ শুদ্ধ হবে না। এটি শুধুমাত্র ইবাদত নয়, এটি আল্লাহর সাথে আমাদের বিশেষ এক সংযোগ। সেই সংযোগ যেন ভুলের কারণে নষ্ট না হয়।”

শায়খ আরও ব্যাখ্যা করলেন, “ইহরামের পূর্বে যেমন কিছু ভুল হতে পারে, তেমনি ইহরাম পড়ার সময়ও অনেক ভুল হয়ে থাকে। ইহরাম শুধু একটি পোশাক নয়, এটি আমাদের আত্মার বিশুদ্ধতার প্রতীক, আমাদের ইবাদতের শুরু। এখানে সামান্য ভুলও হজের পবিত্রতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।”

প্রথম ভুল,” তিনি বললেন, “ইহরামের পূর্বেই মীকাত অতিক্রম করা। মীকাত সেই নির্দিষ্ট সীমা, যেখানে আমাদের ইহরামের নিয়ত করতে হয়। যদি আমরা সেই সীমা অতিক্রম করি ইহরাম ছাড়া, তবে আমাদের হজ্জে ভুল হবে।”

শায়খের কণ্ঠে ছিল গভীর উদ্বেগ। তিনি আরও বললেন, ইহরামের পূর্ব মুহূর্তে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন না করা। এটি আমাদের শারীরিক বিশুদ্ধতার প্রতীক, যা আমাদের অন্তরের বিশুদ্ধতার সাথে সম্পৃক্ত।

তারপর তিনি নারীদের বিষয়ে বিশেষ সতর্ক করলেন, “ইহরাম বাঁধার পর নিকাব বা হাত মোজা পরা ঠিক নয়। এটা আমাদের হজ্জের নিয়মের বাইরে চলে যায়। আমরা যেন আল্লাহর বিধানকে সঠিকভাবে মেনে চলি।”

শায়খের কণ্ঠে শোনা গেল একধরনের দুশ্চিন্তা, যখন তিনি বললেন, “অনেকেই মনে করেন, ইহরামের স্যান্ডেল বা চটিতে সেলাই থাকলে তা নিষেধ। কিন্তু আসলে এটি ঠিক নয়। ইবাদতের নিয়ম সম্পর্কে ভুল ধারণা আমাদের ইবাদতকে দুর্বল করে দিতে পারে।

তিনি আরও একটি ভুলের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, “অনেকে মনে করেন, মীকাতের মসজিদেই ইহরাম বাঁধতে হবে। কিন্তু ইহরাম বাধার জন্য মীকাতের মসজিদে যাওয়া জরুরী নয়। মীকাতে এসে শুধুমাত্র নিয়ত করতে হয়। “ 

একটু থেমে, গভীরভাবে শায়খ বললেন, “ইহরাম করার সময় অনেকেই ছবি তোলেন। যেন এটি স্মৃতিমূলক কোনো অনুষ্ঠান। কিন্তু এটি ইবাদতের সময়, এখানে স্মৃতির জন্য ছবি তোলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একাগ্রতা ও বিনয়।

শায়খ আমাদের আরেকটি ভুল সম্পর্কে সতর্ক করলেন, “অনেকে মনে করেন, একবার ইহরামের কাপড় পরলে, তা পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ ইহরামের পোশাক পরিবর্তন করা যায়, যদি তা পরিষ্কার থাকে এবং ইহরামের শর্ত ঠিক থাকে।”

অবশেষে তিনি বললেন, “তাওয়াফে কুদূম ছাড়া অন্য সময় ইদতিবা, অর্থাৎ ডান কাঁধ খোলা রাখা ভুল। ইহরামের সঠিক নিয়মগুলো সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত, যাতে করে আমরা আল্লাহর সামনে শুদ্ধভাবে হাজির হতে পারি।”

শায়খ তার অভিজ্ঞতা থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, “হজ্জের সময় হাজীরা এত উত্তেজিত থাকে যে, বারবার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরেও তাওয়াফে কিছু ভুল করে ফেলে। যেন এই উত্তেজনার কারণে ভুলগুলো সম্পর্কে মনেই থাকে না। অথচ হজ্জ এমন এক ইবাদত, যেখানে আমাদের প্রত্যেকটি কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হবে।

শায়খের কণ্ঠে দুশ্চিন্তার সুর স্পষ্ট ছিল যখন তিনি বললেন, “একটি সাধারণ ভুল, যা প্রায় প্রতিটি হাজী করে, তা হলো হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার প্রচণ্ড চেষ্টা করা। তারা এমনভাবে চুম্বন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন এটি হজ্জের মূল কাজ। অনেক সময় মারামারি পর্যন্ত হয়ে যায়, যেন চুম্বন করতেই হবে। কিন্তু এই আচরণ হজ্জের শান্তিপূর্ণ এবং সম্মানিত পরিবেশকে ব্যাহত করে।

তারপর তিনি বললেন, “আমি এমনও দেখেছি, কিছু হাজী কাবার গিলাফ ধরে ঘষাঘষি করেন, যেন গিলাফ থেকে কোনো বিশেষ বরকত সংগ্রহ করবেন। কেউ কেউ তাদের জায়নামাজ বা ইহরামের কাপড় কাবার গিলাফের সাথে মেলান, ভাবেন এতে তাদের ইবাদত আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। অথচ এগুলো কেবল ভুল ধারণা।”

শায়খের কণ্ঠে ছিল গভীর আন্তরিকতা, যখন তিনি তাওয়াফের কিছু সাধারণ ভুলের কথা বললেন, যা সবার ইবাদতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিনি প্রথমেই বললেন, “অনেকে হাজরে আসওয়াদের আগেই তাওয়াফ শুরু করেন। অথচ তাওয়াফ শুরু করতে হবে ঠিক হাজরে আসওয়াদ বা সবুজ বাতির জায়গা থেকে।

শায়খ আরও বললেন, “প্রথম তিন চক্করের বেশি রমল করা, অর্থাৎ দ্রুত হাঁটা, একটি ভুল। রমল করা হয় শুধু প্রথম তিন চক্করে, এরপর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হবে।”

তারপর তিনি হাজরে আসওয়াদের চুম্বন নিয়ে কথা বললেন। “ভিড় তৈরি করে, জোর করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার চেষ্টা করা একেবারে ভুল। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন একটি সুন্নত কাজ, কিন্তু মারামারি বা জোর করে তা করা কখনোই সঠিক নয়।

শায়খ তখন আরও একটি সাধারণ ভুল তুলে ধরলেন, “অনেকে কাবার প্রতিটি কর্ণার স্পর্শ কিংবা চুম্বন করেন। কিন্তু কাবার প্রতিটি কর্ণার চুম্বন করার নিয়ম নেই। শুধু হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানি বিশেষ স্থান, বাকি অংশে চুম্বন করা কিংবা স্পর্শ করার প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, “কাবার গিলাফ ধরে রাখা, বুক মিলানো—এসব আচরণও ভুল। আমাদের মনে রাখা উচিত, কাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন মানে এই নয় যে, আমরা এসব কাজ করব।

তিনি আরও বলেন, “অনেক হাজী হাজরে আসওয়াদের আগেই তাওয়াফ শেষ করে দেন, যা স্পষ্ট একটি ভুল। তাওয়াফ সম্পূর্ণ করতে হবে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত।

শায়খ তখন গুরুত্ব দিয়ে বললেন, “রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে বিশেষ দোয়া আছে, যা পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকে এই অংশে দোয়া না পড়ে ভুল করে ফেলেন।

সবশেষে, শায়খ নারীদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা দিয়ে বললেন, “তাওয়াফের সময় নারীদের অবশ্যই হিজাব পালনে সচেতন থাকতে হবে। অনেক সময় ভিড়ের মধ্যে তাদের হিজাব সঠিকভাবে থাকে না, যা অনুচিত।

শায়খ তার বয়ান অব্যাহত রাখলেন, মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে নামাজ আদায় করা নিয়ে। তার চোখে মুখে ছিল একধরনের বেদনা, যেন বহু বছর ধরে তিনি একই ভুলগুলো দেখে আসছেন। তিনি বললেন, “তাওয়াফ শেষ হওয়ার পর মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত, আর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। কিন্তু আমি অনেক হাজিকে দেখি, তারা দুই রাকাতের জায়গায় চার রাকাত, ছয় রাকাত পর্যন্ত পড়ে ফেলেন। অথচ হজ্জের নিয়মে শুধু দুই রাকাতই পড়ার কথা। এই ভুল আমাদের থেকে কেন হয়? হয়তো উত্তেজনা, হয়তো মনোযোগের অভাব। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাই নিয়মের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

তার কণ্ঠে ধীরে ধীরে গভীর চিন্তা মিশে যাচ্ছিল, যখন তিনি বললেন, “অনেকে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে নামাজ পড়তে গিয়ে ভিড় তৈরি করেন। যেন এই স্থানেই নামাজ পড়তেই হবে। কিন্তু আসলে মাকামে ইব্রাহিমের কাছাকাছি যেকোনো জায়গায় নামাজ পড়া যায়। আল্লাহ আমাদের সহজ করে দিয়েছেন, কিন্তু আমরা ভুলের কারণে অনেক সময় তা কঠিন করে তুলি।

শায়খ আরও সতর্ক করলেন, “তাওয়াফের দু’রাকাত সালাতের পর সেখানে বসে লম্বা দোয়া করা জরুরি নয়। আমাদের প্রতিটি ইবাদত সংযম এবং শৃঙ্খলার সাথে করা উচিত।

এরপর শায়খ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সা’ইয়ের সময় যে ভুলগুলো হাজীরা করে, তা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা শুরু করলেন। তার চোখে ছিল একধরনের উদাসীনতা, যেন তিনি বহুবার এসব ভুল দেখে হতাশ হয়েছেন।

তিনি বললেন, “সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে যেখানে সবুজ লাইট আছে, সেই জায়গায় পুরুষদের দ্রুত গতিতে হাঁটা একটি সুন্নত কাজ। কিন্তু আমি দেখেছি অনেক হাজী সাহেব এই জায়গায় গিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটেন, ভুলে যান সুন্নতের আদব। অথচ এটি আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সুন্নত, যা আমাদের অনুসরণ করা উচিত। আর মহিলাদের জন্য এ জায়গায় স্বাভাবিকভাবে হাঁটা সুন্নত, কিন্তু অনেক মহিলাকে দেখা যায়, তারাও দ্রুত গতিতে হাঁটেন বা দৌড়ান, যা ঠিক নয়

শায়খের কণ্ঠ তখন আরও গভীর হয়ে উঠল, যখন তিনি বললেন, “আরেকটি সাধারণ ভুল হলো, সা’য়ীর সময় পুরুষরা ইদতিবা করা, অর্থাৎ ডান কাঁধ খোলা রাখা। কিন্তু ইদতিবা শুধু তাওয়াফের সময় করা হয়, সা’য়ীর সময় নয়। এই ভুলগুলো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর ইবাদতে শুদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শায়খ তখন আমাদের উমরার শেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজের দিকে মনোযোগ দিলেন—মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা। তার কণ্ঠে ছিল গভীর গুরুত্ব, এই কাজটি না করা মানে ইহরামের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বললেন, “সা’ই শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো চুল ছোট করা বা মাথা মুণ্ডানো। এটি ছাড়া ইহরাম খোলার কোনো সুযোগ নেই। অথচ অনেক হাজী এই জায়গায় এসে ভুল করে থাকেন, হয়তো না জানার কারণে, হয়তো অজ্ঞতার কারণে।

শায়খ তখন ধীরে ধীরে চুল ছোট করার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ ভুল তুলে ধরলেন। “ভুলটি হলো, পুরুষরা সম্পূর্ণ মাথার চুল না কেটে মাথার কিছু অংশ থেকে কেটে ফেলে। অথচ ইসলামের বিধানে সম্পূর্ণ মাথার চুল ছোট করা সুন্নত, এতে আল্লাহর আরও বেশি সন্তুষ্টি পাওয়া যায়।

তিনি আরও একটি ভুলের দিকে ইঙ্গিত করলেন, “অনেকেই সা’য়ী শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানেই চুল কেটে ফেলেন। অথচ এটি সঠিক স্থান নয়। আমাদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা নির্দিষ্ট জায়গায়, সঠিকভাবে করতে হবে।

শায়খ তখন গভীর মনোযোগে বললেন, “আমরা উমরার কিছু ভুল সম্পর্কে জানলাম, এখন আমরা হজ্জের কিছু ভুলের দিকে তাকাবো।

তারপর তিনি ৮ই জিলহজ্জের দিন অর্থাৎ ‘তারবিয়ার দিন’ সংক্রান্ত কিছু ভুলের কথা বললেন। তার কণ্ঠে ছিল সতর্কবার্তার সুর, যেন এই ভুলগুলো করা মানে হজের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। 

প্রথম ভুলটি হলো,” শায়খ বললেন, “অনেকে নিজেদের বাসস্থানের পরিবর্তে কাবার চত্বরে গিয়ে ইহরাম বাঁধেন। অথচ কাবার চত্বরে ইহরাম বাঁধা সুন্নত নয়, বরং আমাদের উচিত নিজেদের নির্ধারিত জায়গা থেকেই ইহরাম করা।

তারপর তিনি বললেন, “অনেক হাজী তামাত্তু হজ্জ পালনের সময় মিনায় যাত্রার আগে একটি নফল তাওয়াফ করে হজ্জের সাই সেরে ফেলেন। অথচ এটি হজ্জের সঠিক নিয়মের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

শায়খ আরও একটি ভুলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, “অনেক হাজী ৮ই জিলহজ্জে মিনায় অবস্থান না করে অন্যত্র অবস্থান করেন, যা সঠিক নয়। মিনায় অবস্থান করা সুন্নত এবং হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তিনি আরও বলেন, “অনেক হাজী মিনায় যুহর, আসর কিংবা মাগরিব-ইশার সালাত একত্রে জমা করে পড়েন, যা ভুল। আমাদের আল্লাহর নির্দেশিত সময় অনুযায়ীই নামাজ আদায় করতে হবে।

এরপর শায়খ বললেন, “৯ই জিলহজ্জ বা আরাফার দিন হলো হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। অথচ অনেক হাজী এটি জানেন না, এবং ভুলের কারণে আরাফার ময়দানের বাইরে অবস্থান করেন। অথচ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা জরুরি। এটি হজের মূল অংশ, যেখানে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

শায়খ আরও কিছু ভুলের কথা বললেন, “অনেক হাজী আরাফার ময়দানে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করার পরিবর্তে জাবালে আরাফার দিকে মুখ করে দোয়া করেন, ভেবে যে এতে বেশি ফযিলত রয়েছে। অথচ এটি সঠিক নয়। আমাদের কিবলামুখী হয়েই দোয়া করতে হবে।

শায়খ তখন আরও বললেন, “চার রাকাত বিশিষ্ট সালাত কসর না করা, এবং জমা না করা আরেকটি ভুল। হজের এই সময়ে আমাদের উচিত সালাত কসর এবং জমা করা, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সহজীকরণ।

তার শেষ সতর্কবাণী ছিল সূর্যাস্তের আগে আরাফাহ ত্যাগ করা সম্পর্কে। “অনেকেই ভুল করে সূর্যাস্তের আগে আরাফাহ ত্যাগ করেন, যা হজের নিয়মের পরিপন্থী। আমাদের ধৈর্য ধরে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে।

৯ই জিলহজ্জ সন্ধার পর হাজার হাজার হাজিরা আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফার দিকে রওনা দেন। ক্লান্ত শরীর, তবু মনে প্রশান্তি। আল্লাহর ঘরে এসে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা প্রতিটি হৃদয়ে। কিন্তু পথটা সহজ নয়, অনেক কঠিন। মুজদালিফার পথে গাড়ির লম্বা সারি, যেন থেমে থাকা এক বিশাল স্রোত।

অনেক হাজি জানেন না, মুজদালিফায় রাত কাটানো হজ্জের অংশ। অজানা অন্ধকারে গাড়িতেই বসে থাকেন, অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে রাত পার করে দেন। মুজদালিফায় পৌঁছানোর সুযোগ হয় না তাদের, আর সেই সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে বঞ্চিত হতে হয় —মুজদালিফার খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন, যা হজের এক অপরিহার্য অংশ।

শায়খ সবাইকে আরও বললেন, “অনেকে মাগরিব ও ইশার নামাজ আগে থেকেই আদায় করে ফেলেন, অথচ মুজদালিফায় একত্রে এই নামাজ পড়া বিধান। এছাড়া, পাথর সংগ্রহের নিয়ম নিয়েও অনেক ভুল ধারণা থাকে। অনেকে মনে করেন, মুজদালিফা ময়দান থেকেই পাথর সংগ্রহ করতে হবে, অথচ এটি বাধ্যতামূলক নয়।

তিনি আরও সতর্ক করলেন, “পাথর নিক্ষেপের সময় অনেকেই কষ্ট পায় কারণ কেউ কেউ ভিড়ের মধ্যে জোর করে পাথর নিক্ষেপ করেন। এমনকি কেউ কেউ সাতটি পাথর একবারে নিক্ষেপ করেন, যা শরীয়তসম্মত নয়। প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় ‘আল্লাহু আকবার’ না বলাও একটি বড় ভুল।” 

অনেক হাজীর মধ্যে এমন একটি ভুল ধারণা থাকে যে কুরবানির কাজ শেষ হলেই হজ্জ শেষ হয়ে গেল। শায়খ সাহেব যখন হজ্জে গিয়েছিলেন, তখনও তিনি দেখেছিলেন অনেক হাজী কোরবানি শেষ করার পর বিশ্রাম নিচ্ছেন, হাসিমুখে মনে করছেন, “এখন তো হজ্জ শেষ হয়ে গেল।” অথচ তখনও হজ্জের অনেক কাজ শেষ হয়নি। 

তিনি আরও সতর্ক করলেন “১০ ও ১১ তারিখে মিনায় অবস্থান করা জরুরী, এটি একটি বাধ্যতামূলক কাজ। কিন্তু অনেক হাজী বিভিন্ন অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে মিনায় অবস্থান না করার চেষ্টা করেন।” আল্লাহর সামনে হাজীর আত্মসমর্পণ শুধুমাত্র ইচ্ছায় নয়, কাজেও প্রতিফলিত হতে হবে।

আরেকটি সাধারণ ভুল হলো, অনেক হাজী মনে করেন, মিনার মূল সীমানার বাইরে, সম্প্রসারিত এলাকায় অবস্থান করলে মিনার অবস্থান পূর্ণ হবে না। এই ভুল ধারণা অনেকের মধ্যে প্রচলিত, অথচ শরীয়তে এটি সঠিক নয়। মিনার সম্প্রসারিত সীমানার মধ্যে অবস্থান করলেও তা শুদ্ধ বলে গণ্য হবে।

শায়খ সাহেব বললেন “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুলটি হলো, হজ্জের কাজ সম্পূর্ণ শেষ করার পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করে ফেলা। অনেকেই কুরবানি ও শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের পর মনে করেন, সব কাজ শেষ। অথচ বিদায়ী তাওয়াফ না করে হজের পূর্ণতা আসে না। এই তাওয়াফ হজ্জের শেষ অধ্যায়, যা আল্লাহর ঘরের প্রতি হাজীর শেষ বিদায় এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণতা প্রদর্শনের প্রতীক “

শফিক সাহেব নিজের ভেতরে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব করছিলেন। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি তাওয়াফ, প্রতিটি দোয়া তাকে যেন আরও বেশি আল্লাহর কাছে টেনে নিচ্ছিল। হজ্জের প্রতিটি কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য তিনি প্রশিক্ষণে পাওয়া সমস্ত জ্ঞান প্রয়োগ করেছিলেন। 

শফিক সাহেব তার এই হজ্জের যাত্রায় দেখলেন, কত মানুষ এমন ছোট ছোট ভুল করে ফেলেন, যা তাদের ইবাদতের পূর্ণতা নষ্ট করে দেয়। অথচ এই ভুলগুলো শুধরে নিলে হজ্জ হবে সম্পূর্ণ এবং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। কেউ পাথর নিক্ষেপের সময় সঠিক নিয়ম মেনে চলছেন না, কেউ আবার আরাফার দিনের গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারছেন না। শফিক সাহেব নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থেকে তাদের ভুলগুলো শুধরে দিচ্ছিলেন, যেন তাদের হজ্জ পূর্ণতা পায়।

যখন হজ্জের সব কার্যক্রম শেষ হল, তখন শফিক সাহেব তার অন্তরের ভারমুক্তি অনুভব করলেন। তার মনে হচ্ছিল, বহু বছর ধরে জমে থাকা সব পাপ, সব কষ্ট যেন মুছে গেছে। হজ্জের পুরো সময়টা যেন তাকে নতুন করে গড়ে তুলেছিল। তিনি বুঝলেন, হজ্জ শুধু একটি ফরজ ইবাদত নয়, এটি একজন মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির বিশাল মাধ্যম। তিনি অনুভব করলেন, আল্লাহ তাকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন, তাকে একটি নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ দিয়েছেন। 

বাংলাদেশে ফিরে এসে শফিক সাহেবের জীবন ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। যে মানুষটি একসময় নিজের স্বার্থের জন্য অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন, সেই মানুষটি এখন সম্পূর্ণ সৎভাবে কাজ শুরু করলেন। ঘুষ নেওয়া, প্রতারণা—এসব তিনি একেবারে ছেড়ে দিলেন। অফিসে তিনি আগে যে সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে অন্যায়ভাবে লাভবান হতেন, সেগুলো থেকে তিনি দূরে থাকলেন। তার মনে হলো, আল্লাহ তাকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছেন সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য, এবং তিনি আর কখনো সেই সুযোগ হারাতে চান না।

এখন তিনি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দু’আ করেন—যেন তার প্রতিটি ইবাদত পবিত্রভাবে কবুল হয়। তার চোখে বারবার ভেসে ওঠে মক্কার সেই পবিত্র দিনগুলো, যখন তিনি আল্লাহর ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে তার প্রভুর কাছে নিজের সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছিলেন। তার প্রতিটি নামাজে তিনি কাঁদেন, যেন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সঠিক পথে স্থির রাখেন। 

শফিক সাহেবের জীবনটা এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যে মানুষটি একসময় অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে ছুটতেন, এখন তিনি শান্তির সন্ধান পান আল্লাহর ইবাদতে, খোদার সন্তুষ্টির মধ্যেই তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান। আল্লাহ তাকে পথ দেখিয়েছেন, আর শফিক সাহেব সেই পথে ধীর পায়ে, পরম বিনম্রতায় হাঁটছেন, যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *