হজ্জ: আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার পথ
হজ্জ হল ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, যা প্রত্যেক শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলমানের জীবনে অন্তত একবার সম্পন্ন করা ফরজ। এটি মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার পথ তৈরী করে, ক্ষমা প্রার্থনা, এবং আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রতি বছর প্রায় তিরিশ লাখ মুসলমান পবিত্র এই হজ্জ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন, যা পাঁচ দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় এবং ইসলামীক চান্দ্র পঞ্জিকার শেষ মাস জিলহাজ্জে পালিত হয়ে থাকে।
হজ্জ যাত্রার সময়, মুসলমানদের ইহরাম করতে হয়, যা একটি বিশেষ পবিত্র অবস্থা। ইহরামের সময় কিছু কাজ নিষিদ্ধ থাকে, যেমন; যৌন সম্পর্ক, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা করা, এবং চুল বা নখ কাটা। এই অবস্থায় মুসলমানদের নিজেদের প্রশান্তি এবং ধৈর্য ধরে রাখতে হয়, যতই শারীরিক বা মানসিক ক্লান্তি অনুভূত হোক না কেন, কারণ এটি হজ্জের মূলভিত্তিক আধ্যাত্মিকতার অংশ।
হজ্জের সংজ্ঞা
হজ্জ একটি আরবি শব্দ । বিশদভাবে, আমরা এটিকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি “আকাঙ্ক্ষা করা, সংকল্প করা, একটি মহান কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করা” ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়াহর পরিভাষায় হজ্জের সংজ্ঞা হল: “সুনির্দিষ্ট সময়ে, সুনির্দিষ্ট কিছু আমল পালনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ এবং এর আশেপাশের নিদর্শনমূলক স্থানগুলো যিয়ারতের ইচ্ছা পোষণ করা।” এটি একটি বিশেষ যাত্রা, যা শুধুমাত্র কিছু শারীরিক ইবাদতের সাথে সম্পর্কিত নয়; বরং এটি ইসলামের ঐতিহাসিক ঘটনা, বিশ্বাস এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা বলে”
হজ্জের ইতিহাস
হজ্জের বাধ্যবাধকতা মহান আল্লাহ কর্তৃক নবী ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময়ে নির্ধারিত হয়েছিল, যাকে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কাবা নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
“এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ই‘তিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫]
কা‘বা ও হজ্জের ইতিহাসে রয়েছে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহৎ ইসলামী আখ্যান। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার স্ত্রী হাজেরা আলাইহিস সালামকে ও পুত্র ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে মরুময়, পাথুরে ও জনশূন্য মক্কা উপত্যকায় রেখে আসার নির্দেশ দেন -এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) স্ত্রী হাজেরা আলাইহিস সালামকে ও পুত্র ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে মরুময়, পাথুরে ও জনশূন্য মক্কা উপত্যকায় রেখে যাওয়ার সময় এই দোয়া করেছিলেন:
“হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমি আমার কিছু বংশধরদেরকে ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি স্থাপন করালাম, হে আমাদের রব, যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের হৃদয় আপনি তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন এবং তাদেরকে রিয্ক প্রদান করুন ফল-ফলাদি থেকে, আশা করা যায় তারা শুকরিয়া আদায় করবে।” [সূরা ইব্রাহিম: ৩৭]
হজ্জে কী ঘটে?
হজ্জ মূলত পাঁচ দিনের একটি কর্মধারা নিয়ে গঠিত, যা ৮ই জিলহজ্জ থেকে শুরু হয়ে ১২ই জিলহজ্জ পর্যন্ত চলে। হজ্জের দিনগুলোতে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হয়।
৮ যিলহজ্জ
ইহরাম বাঁধার পর হাজীরা ৮ যিলহজ্জ ফজরের নামাজের পরে সকালে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং মিনায় পৌঁছে যুহরের নামাজ আদায় করেন। ওই দিনে মিনায় অবস্থান করা সুন্নাহ হিসেবে বিবেচিত। যদি কেউ মিনায় অবস্থান না করেন, তবে তিনি এই সুন্নাহর ফজিলত থেকে বঞ্চিত হবেন, তবে এর ফলে তার হজ্জ বাতিল হবে না। মিনায় তারা যুহর, আসর, মাগরিব, ইশা এবং পরদিন ফজরের নামাজ আদায় করে থাকেন।
৯ যিলহজ্জ
৯ যিলহজ্জ ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাজীগণ আরাফার দিকে রওয়ানা দেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন। তারা যুহর ও আসরের নামাজ এক আযান ও দুই ইকামাতে আদায় করেন এবং উভয় নামাজ সংক্ষিপ্ত করেন, যেহেতু এটি সুন্নাহ। আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে, দুই হাত তুলে দীর্ঘ সময় একান্তে দু‘আ করা সুন্নাহ। এই দিনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দু‘আ বা নফল নামাজ নেই। হাজীগণ এই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বেশি বেশি দু‘আ করেন।
সূর্যাস্তের পর হাজীরা মুযদালিফায় এসে মাগরিব ও ইশার নামাজ এক আযান ও দুই ইকামাতে আদায় করে থাকেন।
হাদিসে জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব ও ইশার নামাজ শেষে সময় নষ্ট না করে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তিনি ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করেছিলেন। এরপর তিনি মাশ‘আরুল হারামের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে দু‘আ করেছিলেন। বর্তমানে সেখানে একটি মসজিদ রয়েছে, যাকে ‘মাসজিদে মাশ‘আরুল হারাম’ বলা হয়। সেখানে গিয়ে দু‘আ করা উত্তম, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়। এ সময় মুযদালিফায় অবস্থান করাই মূল কাজ।
১০ যিলহজ্জ
১০ যিলহজ্জে, হাজীরা জামরাতুল আকাবায় সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন যা তিনি মুযদালিফা থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। মুযদালিফা থেকে পাথর নিয়ে আসা সুন্নাহ, যদিও এটি বাধ্যতামূলক নয়, কারণ যেকোনো স্থান থেকেই পাথর সংগ্রহ করে জামরাতুল আকাবায় নিক্ষেপ করা বৈধ। পাথর নিক্ষেপের পর, হাজীরা কুরবানী করেন, এরপর মাথার চুল কামিয়ে হালাল হয়ে থাকেন । এরপর হাজীরা মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ ও সা‘য়ী সম্পন্ন করে আবার মিনায় ফিরে আসেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১০ যিলহজ্জ, অর্থাৎ কুরবানীর দিনে মিনায় এসে এই পাঁচটি কাজ সম্পন্ন করেছিলেন: জামারাতুল আকাবায় পাথর নিক্ষেপ, কুরবানী, হালাল হওয়া, তাওয়াফ এবং সা‘য়ী।
এই পাঁচটি কাজের মধ্যে কুরবানী, হালাল হওয়া, তাওয়াফ ও সা‘য়ী যদি কেউ ঐ দিনে না করে পরের দিন করতে চান, তবে সেটিও বৈধ। এছাড়া, ১০ যিলহজ্জের রাত বা রাতের অধিকাংশ সময় মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব।
১১ যিলহজ্জ
১১ যিলহজ্জে, যুহরের পর ছোট জামারা, মধ্যম জামারা এবং বড় জামারা বা জামারাতুল আকাবায় প্রত্যেকটিতে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। ছোট জামারা ও মধ্যম জামারায় পাথর নিক্ষেপের পর সামনে এগিয়ে দু‘আ করা সুন্নাহ। তবে বড় জামরায় পাথর নিক্ষেপের পর দু‘আ করার নিয়ম নেই। দিনের বেলা পাথর নিক্ষেপ করা উত্তম, তবে যদি কেউ দিনের বেলা পাথর নিক্ষেপ করতে না পারেন, তাহলে রাতেও পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন এবং এতে কোনো অসুবিধা নেই বলে বিশুদ্ধ মত রয়েছে।
এই দিনে পাথর নিক্ষেপ ছাড়া আর কোনো নির্দিষ্ট আমল নেই। তবে কেউ যদি আগের দিনে কুরবানী, হালাল হওয়া, তাওয়াফ এবং সা‘য়ী সম্পন্ন না করে থাকেন, তবে তিনি এই দিনে তা করতে পারেন। ১১ যিলহজ্জের রাত মিনায় কাটানো ওয়াজিব।
১২ যিলহজ্জ
১২ যিলহজ্জে যোহরের পর ছোট, মধ্যম এবং বড় জামারায় যথাক্রমে সাতটি করে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। পাথর নিক্ষেপের পর ছোট ও মধ্যম জামারায় গিয়ে দু‘আ করা সুন্নাহ, কিন্তু বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপের পর দু‘আ করার বিধান নেই।
যারা ১২ যিলহজ্জে মিনা ছেড়ে যেতে চান, তাদের সূর্যাস্তের আগেই মিনার কার্যক্রম শেষ করে বের হওয়া উচিত। যদি কেউ পরের দিন পাথর নিক্ষেপ করতে চান, তবে তাকে ১২ যিলহজ্জের রাত মিনায় কাটাতে হবে। ১২ তারিখের রাত মিনায় কাটালে পরদিন ১৩ যিলহজ্জে আবার পাথর নিক্ষেপ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৩ যিলহজ্জ পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করেছিলেন।
এভাবে হজ্জের মূল কাজগুলো সম্পন্ন করার পর মক্কা ত্যাগের সময় শেষ কাজ হচ্ছে বিদায়ী তাওয়াফ করা। এটি ওয়াজিব। বিদায়ী তাওয়াফ করার পূর্বেই যদি কোনো মহিলার মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয়, তাহলে তার জন্য বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব নয়, তিনি বিদায়ী তাওয়াফ না করেই চলে যেতে পারবেন এবং এজন্য তাকে দম দিতে হবে না। তবে কোনো পুরুষ যদি বিদায়ী তাওয়াফ না করেই চলে যান, তাহলে তাকে দম দিতে হবে।
হজ্জ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হজ্জ বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। হজ্জ হলো এমন একটি ইবাদত যা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ফরজ। অর্থাৎ হজ্জ করার জন্য সেখানে যাওয়া, অবস্থান করা ও ফিরে আসার জন্য সাংসারিক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পদ থাকা এবং শারীরিকভাবে সক্ষম তথা সুস্থ হওয়া।
হজ্জের মাধ্যমে বান্দা সদ্যপ্রসূত নবজাতকের ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কাজ করেনি, সে হজ্জ হ’তে ঐরূপ (নিষ্পাপ অবস্থায়) প্রত্যাবর্তন করে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন’। [বুখারী হা/১৫২১; মুসলিম হা/১৩৫০; মিশকাত হা/২৫০৭]।
অর্থাৎ সে নবজাতক শিশুর ন্যায় যাবতীয় কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসে।[ফাৎহুল বারী ৩/৩৮২]
হজ্জ ও ওমরা অসচ্ছলতা দূর করে সচ্ছলতা আনয়ন করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“তোমরা হজ্জ ও ওমরাহর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখো (অর্থাৎ সাথে সাথে কর)। কেননা এ দু’টি মুমিনের দরিদ্রতা ও গোনাহ সমূহ দূর করে দেয়, যেমন (কামারের) হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের মরীচিকা দূর করে দেয়। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়’। [তিরমিযী হা/৮১০; নাসাঈ হা/২৬৩০; মিশকাত হা/২৫২৪; ছহীহাহ হা/১২০০; ছহীহুত তারগীব হা/১১০৫]
অন্য এক হাদিসে হজের জন্য খরচকৃত সম্পদকে সাতশো গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন,
‘হজের জন্য খরচ করা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার মতোই, যার সওয়াব সাত শ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩০০০)
এছাড়াও হজ্জ ও ওমরাহ পালনকারীকে আল্লাহর মেহমান বলা হয়েছে। আর এক্ষেত্রে মেহমানের সাথে তার আশানুরূপ আচরণ করা হবে। জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘হজ্জ ও ওমরাকারীরা আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদের তা দেওয়া হয়।’ (মুসনাদে বাজজার: ১১৫৩)
হজ্জের উদ্দেশ্য কী?
হজ্জের প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের ওপর আরোপিত একটি ঐশ্বরিক বাধ্যবাধকতা। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন:
“তাতে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে (যেমন) মাক্বামে ইবরাহীম(ইবরাহীমের দাঁড়ানোর জায়গা)। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে নিরাপদ হবে। আল্লাহর জন্য উক্ত ঘরের হাজ্জ করা লোকেদের উপর আবশ্যক যার সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে এবং যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, (সে জেনে রাখুক) নিঃসন্দেহে আল্লাহ বিশ্ব জাহানের মুখাপেক্ষী নন।” [সূরা আলে ইমরান: ৯৭]
হজ্জ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ হলো:
- কালিমায় শাহাদাত: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।
- সালাত: দিনে পাঁচবার নামাজ আদায় করা।
- রোজা: রমজান মাসে রোজা রাখা।
- যাকাত: দরিদ্রদের মধ্যে দান করা।
- হজ্জ: মক্কায় হজ্জ পালন করা।”
উপরে উল্লেখিত প্রমাণগুলো দেখায় যে, হজ্জ ইসলাম ধর্মের একটি স্তম্ভ এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তব্য।
এর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন-
১) তাওহীদ বোঝা, ধারণ করা ও প্রতিষ্ঠা করা।
২) আল্লাহর ‘উবূদিয়্যাত তথা আল্লাহর বান্দা হওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা।
৩) বিশুদ্ধ আখলাক অর্জন করা।
ইসলামিক ক্যালেন্ডারের কোন সময়ে হজ শুরু হয়?
হজ্জ প্রতি বছর একই সময়ে পালিত হয়। এটি জিলহজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত হয়, যা ইসলামিক ক্যালেন্ডারের বারোতম মাস। হাজিদের ৮ই জিলহজ্জ থেকে ১৩ই জিলহজ্জ পর্যন্ত পাঁচ দিন হজ পালনের জন্য ব্যয় করতে হয়। তবে সাধারণত হাজিরা হজের এক বা দুই সপ্তাহ আগে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ সম্পন্ন হওয়ার পর, অনেকেই এক সপ্তাহ মদিনায় থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মসজিদ পরিদর্শন করেন।
হজ্জ কেন বাধ্যতামূলক?
ইসলামে হজ্জ ফরজ, কারণ এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। এই স্তম্ভগুলো মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য ইবাদত এবং আনুগত্যের কাজ। তবে, হজ্জ পালন সকল মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক নয়; এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ::
সামর্থ্য থাকা: হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম হতে হবে। এতে হজ্জের জন্য যাত্রা, সেখানে অবস্থান এবং ফিরে আসার খরচ, সাথে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সম্পদ থাকা জরুরি। শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২) মহিলাদের ক্ষেত্রে: তাদের সঙ্গে স্বামী অথবা কোনো মাহরাম (যার সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ) থাকা আবশ্যক।
৩) বালিগ হওয়া: হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অপরিহার্য। যদি নাবালেগ অবস্থায় হজ্জ পালন করা হয়, তবে তা ফরয হজ্জ হিসেবে গণ্য হবে না। পরবর্তীতে বালিগ হওয়ার পর এবং হজ্জ পালনে সামর্থ্যবান হলে পুনরায় হজ্জ করতে হবে।
৪) আকল সম্পন্ন হওয়া: মানসিকভাবে সুস্থ হওয়া বাধ্যতামূলক।
হজ্জ এবং যাকাতের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কারো জন্য যাকাত ফরজ না হলেও হজ্জ তাদের জন্য ফরজ হতে পারে। যাকাতের ক্ষেত্রে নেসাব (সম্পদের ন্যূনতম সীমা) প্রয়োজন, কিন্তু হজ্জের ক্ষেত্রে মক্কায় যাওয়ার এবং ফিরে আসার খরচ সম্পর্কিত। যদি কারও অপ্রয়োজনীয় সম্পদ বিক্রি করে হজ্জের খরচ বহন করার ক্ষমতা থাকে এবং হজ্জ থেকে ফিরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তবে তার জন্য হজ্জ বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
হজ্জ কিভাবে উদযাপিত হয়?
ইসলাম ধর্মে দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। প্রথমটি রমজান মাসের শেষে পালিত হয়, এটি সেই সময় যখন মুসলিমরা, যারা ইসলামের অনুসারী, ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালন করেন আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার জন্য। রমজান মাসের শেষে এই উৎসবটি ঈদুল ফিতর নামে পরিচিত, যার অর্থ “রোজা ভাঙার উৎসব”।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক উৎসব হজ্জের সাথে সাথে পালিত হয় এবং এটি ঈদুল আজহা নামে পরিচিত। হজ্জ হলো বিশ্বাস, ঐক্য, এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের এক গভীর উদযাপন। হজ্জের চারটি দিক দিয়ে এই উৎসবটি উদযাপিত হয়:
- ঐক্য: হজ্জ বিভিন্ন পটভূমি ও সংস্কৃতির মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে, ইসলামের সর্বজনীনতা প্রকাশ করে। হাজীরা একই ধরনের পোশাক পরিধান করেন এবং পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন, যা মুসলিমদের ভ্রাতৃত্ব ও ভগ্নিত্বের প্রতীক।
- আনুগত্য: হজ্জের আনুষ্ঠানিকতাগুলো আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। হাজীরা শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখেও আল্লাহর আদেশ মেনে চলেন।
- ক্ষমা: আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে হাজীরা প্রার্থনা করেন, যা পাপ ক্ষমার স্থান হিসেবে বিবেচিত । এটি আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার সুযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
- ত্যাগ: পশু কুরবানি করার কাজটি হাজীদের জীবনে ত্যাগের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়, যা শুধু পশু কুরবানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং অন্য মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
হজ্জের লক্ষ্য কী?
হজ্জের প্রধান লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তবে এর সাথে কিছু অন্যান্য লক্ষ্যও রয়েছে, যেমন:
- তাওহীদের ধারণা বোঝা, গ্রহণ করা এবং প্রতিষ্ঠা করা: তাওহীদ ইসলামের মূল বিশ্বাস এবং এটি আল্লাহর একত্ব ও অনন্যত্বের ধারণা প্রকাশ করে। ইসলামের মূল চেতনা হলো “আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই” এবং আল্লাহ একক, অদ্বিতীয়।
- উবুদিয়্যাহ (আল্লাহর প্রতি দাসত্ব) প্রতিষ্ঠা: উবুদিয়্যাহ বা আল্লাহর প্রতি দাসত্ব হলো ইসলামী আত্মিকতার মূল ধারণা। এটি এই বিশ্বাসে নিহিত যে, মানুষকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করা এবং আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
- শুদ্ধ নৈতিক চরিত্র অর্জন: কুরআন ও হাদিসে মানবীয় গুণাবলীর উপর বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং কিভাবে একজন সত্যিকারের মুসলিম সৎ ও শুদ্ধ জীবন যাপন করতে পারেন তা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ফরজ হজ্জ না করার পরিণাম
সামর্থ্য থাকার পরও হজ্জ না করার পরিণাম ভয়াবহ। ফরজ হজ্জ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিস্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ (ইবনে কাসির: ১/৫৭৮)
আর কেউ যদি হজ্জ অস্বীকার করে তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)
এছাড়াও হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তাআলা হজ্জ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান: ৩৭০৩)
উপসংহার
হজ্জ মুসলমানদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা কেবল শারীরিক কার্যকলাপের বাইরে তাদের আস্থার গভীরতা ও ঈমানের দৃঢ়তাকে প্রকাশ করে। এটি মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা, ক্ষমা করা, ও ত্যাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। হজ্জের মূল উদ্দেশ্য হলো এই মূল্যবোধগুলোকে আরও দৃঢ় করা এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা।
হজ্জ সম্পন্ন করার পর, হাজীরা ঐক্য, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনযাপন, অন্যদের প্রতি ক্ষমাশীলতা এবং বৃহত্তর কল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসেন। এই শিক্ষাগুলো তারা শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবনেও প্রতিফলিত করেন, যা তাদের সমাজে বিশ্বাস, দয়া, এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।
Enquire Today
MF Tower (Level 7)
Ga 95/C, Progoti Sarani, Link Road
Gulshan, Dhaka 1212
Bangladesh
+8801913629695, +8801877669390
info@ziyarahbd.com, ziyarahhbd@gmail.com