আরাফার ময়দান: ইসলামের পবিত্রতা ও হজ্জের রুকন
আরাফার ময়দান ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত, যা হজ্জের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এটি এমন একটি স্থান যেখানে প্রতিবছর লাখো মুসলিম হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন পালন করতে সমবেত হন। আরাফার ময়দান মক্কা শহরের বাইরে অবস্থিত এবং এখানে হজ্জের দিনে অবস্থান করা ফরজ বা বাধ্যতামূলক। এটি কেবল একটি ভৌগলিক স্থান নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় দিক থেকে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) এই ময়দানে বিদায় হজের ভাষণ প্রদান করেছিলেন, যা ইসলামের মূলনীতি ও জীবনবিধানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
অবস্থান:
আরাফার ময়দান মক্কার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত, মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। এই বিস্তৃত সমতলভূমিটি প্রায় ৫.৫ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত। আরাফার ময়দান চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত, এবং এর মাঝখানে রয়েছে “জাবালে রহমত” বা রহমতের পাহাড়। এটি এমন একটি স্থান যেখানে হজ্জ যাত্রীরা প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ঐতিহাসিক বিবরণ:
ঐতিহাসিকদের মতে আরাফার ময়দানের ইতিহাস হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) এর সঙ্গে জড়িত। আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) মহান আল্লাহর নির্দেশে বেহেশত থেকে বের হওয়ার পর পৃথিবীতে সর্বপ্রথম তাদের পরস্পর সাক্ষাৎ এই আরাফাত ময়দানে হয়। আদম (আ.) আরাফাত ময়দানে জাবালে রহমতের ওপর বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে অবস্থানকালে দেখতে পান, হাওয়া (আ.) জেদ্দার দিক থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে আসছেন। তখন আদম (আ.) দৌঁড়ে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং অঝোরে কাঁদতে থাকেন। এ সময় আদম ও হাওয়া (আ.) আসমানের দিকে তাকান।
অত:পর মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের দৃষ্টি থেকে পর্দা ওঠিয়ে দিলে তাদের দৃষ্টি আল্লাহর আরশের ওপর গিয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অত:পর আদমকে তার প্রতিপালক কতিপয় বাক্য শিক্ষা দেন। এতে রব তার প্রতি মনোযোগী হন, নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী ও দয়ালু।’ (সূরা বাকারা : ৩৭)।
ইসলামী ইতিহাসে আরাফার ময়দানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের সময় প্রদত্ত ভাষণ। আমাদের নবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণ এ ময়দান সংলগ্ন জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) আরাফার ময়দানে বিদায় হজের দিন, নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন যা ইসলামের মূলনীতি, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতার উপর আলোকপাত করে। এই ভাষণকে ইসলামের সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় জীবনব্যবস্থার মূল দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিদায় হজের ভাষণে নবী (সা.) ঘোষণা করেন যে, সমস্ত মুসলমান একে অপরের ভাই এবং সব ধরনের ভেদাভেদ, জাতিগত বা সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ইসলামে নিষিদ্ধ। তিনি নারীদের অধিকার, সম্পদের সঠিক ব্যবহারের নীতি এবং কুরআনের শিক্ষা মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ভাষণটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও শান্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
আরাফার ময়দান ভ্রমণের নির্দেশিকা:
মক্কা শহর থেকে আরাফার ময়দান মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সাধারণত, হজের সময় আরাফার ময়দানে যাওয়ার জন্য বাস বা অন্যান্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়। হাজিরা নির্ধারিত সময়ে মিনা থেকে আরাফার দিকে যাত্রা শুরু করেন। সাধারন পর্যটকরা মক্কা থেকে গাড়ি বা বাসে সহজেই এখানে পৌঁছতে পারে।