সাদা তাঁবুর নগরী : মিনা
মিনা, সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী একটি উপত্যকা, যা ইসলামের ইতিহাস এবং হজের আচার-অনুষ্ঠানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মিনায় লাখ লাখ হাজির অবস্থানের জন্য বিভিন্ন কম্পানি, সংস্থা ও সরকারি সহযোগিতায় তাঁবু স্থাপন করা হয়। তাঁবু সাদা রঙের হওয়ায় চারদিক শুভ্রতায় ছেয়ে যায়। তাই অনেকে মিনাকে ‘সাদা তাঁবুর নগরী’ও বলে। প্রতি বছর হজের সময় লক্ষ লক্ষ মুসলমান এই উপত্যকায় জমায়েত হন। হজযাত্রীরা সারা দিন নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দিগি করেন।
অবস্থান:
মিনা সৌদি আরবের মক্কা নগরীর পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি পবিত্র উপত্যকা। এটি মূলত মক্কা ও মুজদালিফার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এবং ইসলামের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মিনার মোট দূরত্ব মক্কা থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার।
ঐতিহাসিক বিবরণ:
মিনা প্রান্তরে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের কাজটি মূলত মুসলিম জাতির পিতার হিসেবে খ্যাত নবী হজরত ইবরাহিম আ.-এর অনুসরণে প্রতীকী আমল হিসেবে করা হয়।
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন স্বপ্নযোগে আদেশ পেলেন তার প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে হবে, তখন তিনি কয়েকবার উট কোরবানি করলেন। এরপরও তাকে স্বপ্নে কোরবানির আদেশ দেওয়া হলো।
অনেকের মতে, সেখানে অধিক পরিমাণে জবাই করা হয়, তাই এ স্থানকে মিনা বলা হয়। কারো কারো মতে, আরবরা কোনো স্থানে বেশি মানুষের সমাগম হলে সেটিকে ‘মিনা’ বলে অভিহিত করে। মোট কথা হলো, যেহেতু এ স্থানে অধিক পরিমাণে কোরবানির জন্তু জবাই করা হয় এবং লাখ লাখ হাজি অবস্থান করে, তাই এটি ‘মিনা’ নামে পরিচিত।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন : প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের নিয়ে জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ মিনায় আদায় করলেন। তারপর সকাল বেলায়ই আরাফাতের ময়দানের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। (জামেয়ে তিরিমিজি, ইবনে মাজাহ)। আট জিলহজের দিনে যে কোনো সময় মিনায় উপস্থিত হওয়া যায়। তবে, সুন্নাত হলো জোহরের নামাজ মিনায় উপস্থিত হয়ে আদায় করা। এখানে পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয়।
৯ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন। আরাফাত থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় রাত যাপন ও পাথর সংগ্রহ করেন হাজিরা। ১০ জিলহজ হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারেন, কোরবানি দেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফও সাফা মারওয়া সাঈ করেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করেন।
মিনা ভ্রমণের নির্দেশিকা:
মিনায় অবস্থান শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষত গরম আবহাওয়ার কারণে। তাই হজযাত্রীদের শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে এবং নিয়মিত হাঁটা ও অনুশীলনের মাধ্যমে শরীরকে প্রস্তুত রাখতে হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য হাঁটা, রোদে থাকা, এবং ভিড়ের মধ্যে চলাচল করার মতো শারীরিক কষ্টগুলো সহ্য করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাও জরুরি।হজের সময় মানসিক চাপও একটি বড় বিষয় হতে পারে, তাই মানসিক স্থিরতা এবং ধৈর্য্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিনায় অবস্থান এবং হজের প্রতিটি আচার ধৈর্যের পরীক্ষার পাশাপাশি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও নিবেদনের প্রকাশ।মিনায় অবস্থান করার সময় যে জিনিসগুলো প্রয়োজন হতে পারে তা আগে থেকেই প্রস্তুত করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে:
- হালকা ও আরামদায়ক পোশাক
- ছাতা বা টুপি (সূর্য থেকে রক্ষার জন্য)
- প্রয়োজনীয় ওষুধ
- পানি এবং হালকা খাবার
- প্রার্থনার জন্য জায়নামাজ
- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার সামগ্রী
মক্কা থেকে মিনায় যাওয়ার জন্য হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ যানবাহন ব্যবস্থা করা হয়। মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এবং বিভিন্ন সময়ে পৃথক রুট ব্যবহার করা হয়। সরকারি এজেন্সি বা হজ পরিচালনা কমিটি যাতায়াতের সময়সূচি নির্ধারণ করে দেয়, তাই পূর্ব থেকেই সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা উচিত।
হজের সময় ছাড়া সাধারন পর্যটকরা মক্কা থেকে গাড়ি বা বাসে সহজেই এখানে পৌঁছতে পারে।