কাবা শরীফ: ইসলামের সর্বাধিক পবিত্র স্থান

পৃথিবীর বুকের ওপর এমন কিছু স্থান রয়েছে, যা কেবল একটি ভৌগোলিক অবস্থানের চেয়ে অনেক বেশি। এগুলি হলো ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা, এবং সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ। আর এর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র স্থানটি হলো মক্কার কাবা শরীফ। এটা শুধু পাথরের ঘর নয়, বরং এমন একটি কেন্দ্র, যেখানে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর সামনে বিনম্র হয়ে দাঁড়ায়। কাবা শরীফের গুরুত্ব ইসলামের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্বে গভীরভাবে প্রোথিত, যা প্রাচীনকালের নবী ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর সময় থেকে শুরু হয়েছে।

Kaba

কাবা শরীফ, যা “আল্লাহর ঘর” (বাইতুল্লাহ) নামে পরিচিত, একটি বহু সহস্রাব্দের ইতিহাসের অধিকারী। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, কাবা শরীফ প্রথমে নবী ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর দ্বারা আল্লাহর নির্দেশে নির্মিত হয়। এটি মানবজাতির জন্য একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে এক আল্লাহর উপাসনা করতে পারে।

মক্কার উপত্যকায় কাবা শরীফের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। শহরটি নিজেই একটি মরুভূমির মরূদ্যান যা প্রাচীনকালে বাণিজ্য ও তীর্থযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল, যা সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক আদান-প্রদানের কেন্দ্র ছিল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, কাবা শরীফ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবীয় হস্তক্ষেপের কারণে একাধিকবার পুনর্নির্মাণ হয়েছে। ইসলাম আসার আগেই আরবদের বিভিন্ন উপজাতি কাবা শরীফকে সম্মানের চোখে দেখত। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) যিনি কাবা শরীফকে তার তাওহিদের (একত্ববাদের) মূল উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে আনেন এবং এটিকে ইসলামী উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু করেন।

কাবা শরীফের নকশা সরল হলেও গভীর অর্থবহ। এর ঘনাকার কাঠামোটি গ্রানাইট দিয়ে নির্মিত, এবং এক কোণায় পবিত্র কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) স্থাপন করা হয়েছে। কাবা শরীফের অভ্যন্তর ফাঁকা থাকে, যেখানে শুধু একটি ছোট টেবিল রয়েছে এবং দেয়ালগুলো মার্বেল এবং কুরআনের আয়াতের অলংকরণ দ্বারা সজ্জিত।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কাবা শরীফের আকার কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে, তবে বর্তমানে এর উচ্চতা প্রায় ১৩.১ মিটার এবং প্রতিটি পাশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১.০৩ মিটার থেকে ১২.৮৬ মিটার। কাবা শরীফের চারপাশে রয়েছে মসজিদুল হারাম, যা বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ এবং প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজীদের জন্য এটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

পবিত্র কাবার আবরণ:

কাবার আবরণ সোনার ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সজ্জিত কালো রেশমের কাপড় দিয়ে আবৃত। এই কাপড়কে “কিসওয়া” বলা হয় এবং এটি প্রতি বছর পরিবর্তন করা হয়। এই কাপড়ের মধ্যে ঈমানের ঘোষণা, কালিমায় শাহাদাত, রেশমের সুতো দিয়ে সোনায় লেখা আছে। তার দুই-তৃতীয়াংশ অংশে কুরআনের আয়াত সোনার সুতাও ক্যালিগ্রাফি করা আছে।

হাজরে আসওয়াদ:

Black Stone

কাবা শরীফের পূর্ব দিকের কোণে অবস্থিত একটি পাথর আল-হাজরে আসওয়াদ, যার অর্থ “কালো পাথর”, ইসলাম ধর্মের অন্যতম পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এটি কাবা প্রাঙ্গণে তাওয়াফ (পরিক্রমা) শুরু করার সময় মুসলিমদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কথিত আছে এই পাথরটি জান্নাত থেকে আল্লাহ তায়ালা প্রেরন করেচিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) যখন কাবা নির্মাণ করছিলেন, তখন তারা এই পাথরটি আল্লাহর আদেশে কাবার একটি কোণে স্থাপন করেন।

কথিত আছে, পাথরটি উজ্জ্বল এবং সাদা ছিল, কিন্তু মানুষের পাপের কারণে এটি কালো হয়ে গেছে ।

প্রতিটি তাওয়াফের শুরুতে আল-হাজরে আসওয়াদকে স্পর্শ করে, চুম্বন করা, বা দূর থেকে ইশারা করে চুম্বন করা সুন্নাহ। নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজেও তা পালন করেছেন।

বাব আর-রাহমা:

Bab Ar Rahmat

বাব আর-রাহমা যার অর্থ “দয়ার দরজা,” কাবা শরীফের একটি বিশেষ এবং পবিত্র প্রবেশদ্বার। এটি কাবার উত্তর-পূর্ব দেওয়ালে অবস্থিত এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। কাবা শরীফের প্রবেশদ্বার হিসেবে এটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং মর্যাদাপূর্ণ গুরুত্ব বহন করে আসছে।

১৯৭৯ সালে বিখ্যাত শিল্পী আহমদ বিন ইব্রাহিম বাদর বাব আর-রাহমার বর্তমান স্বর্ণের দরজা তৈরি করেন। এটি সম্পূর্ণরূপে খাঁটি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি এবং এর ওজন ৩০০ কিলোগ্রাম। এই স্বর্ণের দরজা পূর্ববর্তী দরজাটির স্থলাভিষিক্ত হয়, যা ১৯৪২ সালে তাঁর পিতা ইব্রাহিম বাদর তৈরি করেছিলেন। ইব্রাহিম বাদরের তৈরি দরজাটি কাবা শরীফের পূর্ববর্তী সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল।

স্বর্ণের এই দরজাটি শুধু তার ওজন এবং নির্মাণ সামগ্রীর জন্য নয়, বরং এর চমৎকার কারুকার্যের জন্যও বিখ্যাত। দরজাটি মক্কার একটি স্থানীয় কারখানায় তৈরি করা হয়েছিল এবং এটিতে সূক্ষ্ম আরবি ক্যালিগ্রাফি খোদাই করা হয়েছে, যাতে ইসলামী ধর্মগ্রন্থ থেকে আয়াত রয়েছে।

মিযাব আল-রহমা:

Mijab

মিযাব আল-রহমা যার অর্থ “দয়ার ঝরনা,” কাবা শরীফের একটি বিখ্যাত এবং পবিত্র স্থাপনা। এটি সাধারণত “মিযাব” নামেই বেশি পরিচিত এবং কাবা শরীফের ছাদ থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্বর্ণের তৈরি একটি পাইপ বা নালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মিযাব কাবা শরীফের উত্তর দিকে হাজরে ইসমাইলের ওপরে অবস্থিত।

মিযাব আল-রহমা ১৬২৭ সালে কাবা শরীফের পুনর্নির্মাণের সময় স্থাপন করা হয়েছিল। ১৬২৬ সালে এক ভয়াবহ ঝড়ের ফলে কাবা শরীফের চারটি দেওয়ালের মধ্যে তিনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সময়ের পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ায় মিযাব আল-রহমা যুক্ত করা হয়েছিল, যাতে বৃষ্টির পানি সরাসরি কাবার ছাদ থেকে বেরিয়ে হাজরে ইসমাইলের দিকে গড়িয়ে পড়ে।

হাতিম:

Hatim

হাতিম, যা “হিজর ইসমাইল” নামেও পরিচিত, এটি কাবা শরীফের একটি নিম্ন বেষ্টনী, যা মূলত কাবার মূল কাঠামোর অংশ ছিল। এটি একটি আধা-বৃত্তাকার প্রাচীর যা কাবার উত্তর-পশ্চিম প্রাচীরের বিপরীতে অবস্থিত, তবে এটি সরাসরি কাবার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। হাতিম সাদা মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং এর প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় দেড় মিটার।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে হাতিম এবং কাবার মধ্যবর্তী স্থানটি মূল কাবা শরীফের অংশ ছিল। কিন্তু পরে কাবা শরীফ পুনর্নির্মাণের সময় স্থান সংকুলানজনিত কারণে এই অংশটি কাবার মূল কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।

আল-মুলতাজাম:

Multajam

আল-মুলতাজাম, হাজরে আসওয়াদ এবং প্রবেশদ্বারের মধ্যবর্তী এলাকা প্রায় ২ মিটার (৬ ৬/২ ফুট) দীর্ঘ। হজ্জযাত্রীরা কাবা পরিদর্শন করার সময় এই এলাকায় স্পর্শ করা বা দোয়া করা বরকতময় মনে করে।.

মাকামে ইব্রাহিম:

Makame Ibrahim

মাকামে ইব্রাহিম হল একটি পবিত্র স্থান, যা কাবা শরীফের কাছাকাছি অবস্থিত। এটি একটি বিশেষ কাঠামোতে সংরক্ষিত, যা কাঁচ এবং ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি। এই কাঠামোর ভেতরে পাথরের উপর নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন বিদ্যমান। এই পদচিহ্ন ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কাবা শরীফ নির্মাণের সময় ইব্রাহিম (আ.) এই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর নির্দেশে কাবার উপরের অংশগুলো নির্মাণে সহযোগিতা করেন।

কথিত আছে নবী ইব্রাহিম (আ.) এই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে যখন কাবা শরিফ নির্মান করছিলেন তখন এই পাথরটি আল্লাহর রহমতে লিফটের ন্যায় প্রযোজন মত উপরে উঠে যাচ্ছিল আবার নেমে যাচ্ছিল।

আল্লাহর রহমতে, এই পাথর ইব্রাহিম (আ.)-এর পায়ের নিচে নরম হয়ে তার পদচিহ্ন ধরে রাখে, যা আজ পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে।

.

রুকন আল-ইয়ামানি:

Rukne Yamini

”রুকন আল-ইয়ামানি” যা ইয়েমেনী কোণ নামেও পরিচিত, এটি কাবার একটি কোণ যা কেন্দ্র থেকে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান করে।

রুকন আল-শামি:

“রুকন আল-শামি” (আরবী: الركن الشامي), যা শামি কোণ নামেও পরিচিত, এটি কাবার একটি কোণ যা কেন্দ্র থেকে সামান্য উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থান করে।

রুকন আল-ইরাকি:

“রুকন আল-ইরাকি” যা ইরাকি কোণ নামেও পরিচিত, এটি কাবার একটি কোণ যা কেন্দ্র থেকে সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থান করে।

https://en.wikipedia.org/wiki/Kaaba