হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন কি?
হজ্জ কী এবং এর গুরুত্ব
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি এবং এটি জীবনে অন্তত একবার পালন করা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য ফরজ ইবাদত। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখে, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম সৌদি আরবের মক্কায় এসে কাবা শরীফের তাওয়াফ, আরাফাতে অবস্থান, মুজদালিফায় রাত যাপন এবং মিনায় কুরবানি ও শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মতো পবিত্র আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন।
অনেক দম্পতি একসঙ্গে হজ্জ পালন করতে মক্কায় ভ্রমণ করেন। তবে “হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারবেন কি?”—এই প্রশ্নটি অনেকের মনে আসে। কারণ ইহরামের বিধিনিষেধ, মাহরাম সংক্রান্ত নিয়ম এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালন হজ্জে দম্পতিদের অবস্থানকে কিছুটা জটিল করে তুলতে পারে।
এই আর্টিকেলে আমরা হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, ইহরামের নিয়ম, মাহরামের ভূমিকা এবং সৌদি আরব সরকারের পরিচালনাগত দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, যাতে হজ্জ করতে ইচ্ছুক দম্পতিরা স্পষ্ট ধারণা পান।
হজ্জে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার নিয়ম
হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন কিনা, তা নির্ভর করে ইহরামের অবস্থা, হজ্জের বিভিন্ন পর্যায় এবং সৌদি আরবের নিয়মের উপর। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. ইহরামের নিয়ম এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
ইহরাম হলো হজ্জের একটি বিশেষ অবস্থা, যখন হজ্জযাত্রীরা নির্দিষ্ট পোশাক (পুরুষদের জন্য দুটি সাদা কাপড় এবং মহিলাদের জন্য সাধারণ পোশাক) পরেন এবং কিছু নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকেন। ইহরামের সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক (দৈহিক মিলন) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কুরআনের সূরা বাকারায় (২:১৯৭) বলা হয়েছে, “হজ্জের সময় কোনো কামভাব, অশ্লীল কাজ বা ঝগড়া করা যাবে না।”
তবে, ইহরামের অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন, একই তাঁবু বা হোটেল রুমে থাকতে পারেন এবং একে অপরের সাথে সাধারণ কথাবার্তা বা সহযোগিতা করতে পারেন। ইহরামের সময় নিষিদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- শারীরিক সম্পর্ক বা এমন কোনো কাজ যা কামভাব জাগায়।
- সুগন্ধি ব্যবহার করা।
- চুল বা নখ কাটা।
- ঝগড়া বা অশ্লীল কথাবার্তা।
স্বামী-স্ত্রীকে ইহরামের এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে, তবে তারা একসঙ্গে থাকতে বা হজ্জের আচার পালনে একে অপরকে সাহায্য করতে পারেন।
২. মাহরাম হিসেবে স্বামীর ভূমিকা
ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী, একজন মহিলা হজ্জ পালনের জন্য ভ্রমণ করতে চাইলে তার সাথে একজন মাহরাম (নিকটাত্মীয় পুরুষ, যেমন স্বামী, বাবা, ভাই, ছেলে) থাকতে হবে। স্বামী সাধারণত একজন মহিলার প্রধান মাহরাম হিসেবে বিবেচিত হন। তাই হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন, এবং স্বামী তার স্ত্রীর জন্য মাহরাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মাহরাম হিসেবে স্বামীর দায়িত্ব হলো স্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভ্রমণে সহায়তা করা এবং হজ্জের আচার-অনুষ্ঠানে স্ত্রীকে সঠিকভাবে গাইড করা। এই কারণে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকা এবং একে অপরের সঙ্গী হওয়া হজ্জের অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ ও অর্থবহ করে।
৩. মক্কায় থাকার ব্যবস্থা
মক্কায় হজ্জযাত্রীদের জন্য হোটেল, গেস্ট হাউস বা তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি বা বেসরকারি হজ্জ প্যাকেজের মাধ্যমে দম্পতিদের জন্য একই রুমে বা একই তাঁবুতে থাকার সুবিধা দেওয়া হয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে ভিড় বা স্থান সীমিত হওয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা তাঁবুতে থাকতে হতে পারে, বিশেষ করে মিনা বা আরাফাতে।
সৌদি আরব সরকার এবং হজ্জ এজেন্সিগুলো চেষ্টা করে দম্পতিদের একসঙ্গে থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আপনি যদি বেসরকারি প্যাকেজ নির্বাচন করেন, তাহলে অতিরিক্ত খরচে আরও ভালো থাকার সুবিধা পেতে পারেন, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর জন্য আলাদা রুম নিশ্চিত করা হয়।
৪. আরাফাত, মুজদালিফা এবং মিনায় থাকা
হজ্জের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার বিষয়টি কিছুটা জটিল হতে পারে:
- আরাফাত: জিলহজ মাসের ৯ম দিনে হজ্জযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। এখানে তাঁবুগুলো সাধারণত বড় এবং অনেক হজ্জযাত্রী একসঙ্গে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী একই তাঁবুতে থাকতে পারেন, তবে লিঙ্গভিত্তিক আলাদা ব্যবস্থাও থাকতে পারে।
- মুজদালিফা: আরাফাত থেকে মুজদালিফায় রাত্রিযাপনের সময় হজ্জযাত্রীরা খোলা আকাশের নিচে থাকেন। এই সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন, তবে ইহরামের নিয়ম মেনে চলতে হবে।
- মিনা: মিনায় তাঁবুগুলোতে থাকার ব্যবস্থা থাকে। সৌদি সরকার চেষ্টা করে দম্পতিদের জন্য একসঙ্গে থাকার সুবিধা দেওয়ার, তবে ভিড়ের কারণে কখনো কখনো পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা তাঁবু বরাদ্দ করা হয়।
এই স্থানগুলোতে থাকার ব্যবস্থা হজ্জ প্যাকেজ এবং সৌদি সরকারের নিয়মের উপর নির্ভর করে।
ইহরামের সময় স্বামী-স্ত্রীর আচরণবিধি
ইহরামের সময় স্বামী-স্ত্রীকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু শারীরিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ, তাই দম্পতিদের এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে যা ইহরাম ভঙ্গ করতে পারে। তবে, তারা একে অপরকে হজ্জের আচার পালনে সাহায্য করতে পারেন, যেমন:
- তাওয়াফ বা সাঈয়ের সময় একে অপরকে সঙ্গ দেওয়া।
- দোয়া ও জিকিরে একসঙ্গে অংশ নেওয়া।
- ভ্রমণের সময় একে অপরের নিরাপত্তা ও আরাম নিশ্চিত করা।
সৌদি আরবের নিয়ম ও ব্যবস্থাপনা
সৌদি আরব সরকার হজ্জের সময় দম্পতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে। উদাহরণস্বরূপ:
- থাকার সুবিধা: মক্কা ও মিনায় দম্পতিদের জন্য আলাদা তাঁবু বা হোটেল রুমের ব্যবস্থা করা হয়। বেসরকারি প্যাকেজে আরও আরামদায়ক থাকার সুবিধা পাওয়া যায়।
- পরিবহন: হজ্জের সময় মক্কা, আরাফাত, মুজদালিফা এবং মিনার মধ্যে পরিবহন ব্যবস্থায় দম্পতিদের একসঙ্গে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া হয়।
- নিরাপত্তা: সৌদি সরকার মহিলা হজ্জযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য মাহরামের উপস্থিতি নিশ্চিত করে।
এছাড়া, নুসুক (Nusuk) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হজ্জযাত্রীরা তাদের থাকার সুবিধা ও প্যাকেজ নির্বাচন করতে পারেন, যেখানে দম্পতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার উল্লেখ থাকে।
হজ্জে দম্পতিদের জন্য প্রস্তুতি
- ইহরামের নিয়ম শেখা: হজ্জের আগে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই ইহরামের নিয়ম ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বাংলাদেশে হজ্জ অফিস বা এজেন্সিগুলো এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
- থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা: হজ্জ প্যাকেজ নির্বাচনের সময় দম্পতিদের জন্য একসঙ্গে থাকার সুবিধা আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
- শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি: হজ্জের সময় ভিড়, গরম আবহাওয়া এবং দীর্ঘ সময়ের ইবাদত শারীরিকভাবে কঠিন হতে পারে। স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই ফিটনেস প্রশিক্ষণ ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।
- মাহরামের দায়িত্ব: স্বামীকে মাহরাম হিসেবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যেমন স্ত্রীর নিরাপত্তা ও সুবিধা নিশ্চিত করা।
- আর্থিক পরিকল্পনা: হজ্জের খরচ বহনের জন্য আগে থেকে সঞ্চয় ও বাজেট তৈরি করুন। বেসরকারি প্যাকেজে দম্পতিদের জন্য আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা বেছে নেওয়া যেতে পারে।
হজ্জে স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার সুবিধা
স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে হজ্জ পালন করলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়:
- আধ্যাত্মিক বন্ধন: হজ্জের সময় একসঙ্গে ইবাদত করা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আধ্যাত্মিক বন্ধনকে আরও গভীর করে।
- সহযোগিতা: হজ্জের কঠিন পরিস্থিতিতে একে অপরকে সাহায্য করা যায়, যেমন তাওয়াফ বা সাঈয়ের সময়।
- নিরাপত্তা: স্বামী মাহরাম হিসেবে স্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, যা হজ্জের ভিড়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
- অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি: হজ্জের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা একসঙ্গে ভাগ করে নেওয়া দম্পতির সম্পর্ককে আরও মজবুত করে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে থাকার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে:
- ভিড় ও স্থান সীমাবদ্ধতা: মিনা বা আরাফাতে তাঁবুতে স্থান সীমিত হওয়ায় দম্পতিদের আলাদা থাকতে হতে পারে।
- ইহরামের বিধিনিষেধ: ইহরামের নিয়ম মেনে চলা কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা।
- শারীরিক ক্লান্তি: হজ্জের দীর্ঘ ইবাদত ও ভ্রমণ দম্পতিদের জন্য শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আগে থেকে প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা এবং ধৈর্য প্রয়োজন।
উপসংহার
হজ্জের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেন, তবে ইহরামের নিয়ম ও সৌদি আরবের ব্যবস্থাপনা মেনে চলতে হবে। স্বামী মাহরাম হিসেবে স্ত্রীর সঙ্গী হন এবং মক্কা, আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনায় একসঙ্গে থাকার সুযোগ থাকে। তবে, ইহরামের সময় শারীরিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ এবং দম্পতিদের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। সৌদি সরকার ও হজ্জ এজেন্সিগুলো দম্পতিদের জন্য থাকার ও পরিবহনের ব্যবস্থা করে, যা এই যাত্রাকে সহজ করে।







